এখনও তোমার সেই ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনতে পাই ;
এখনও তোমার সেই দারুণ বিলাপ কানে বাজে ।
গগনবিহারী চিল,
খর দীপ্র দুুপুরবেলায়
তুমি এক আকাশের থেকে অন্য আকাশের দিকে
তেজস্বী ও স্বভাবত-সঙ্গীহিন সম্রাটের মতো
সহজ উল্লাসে
বাতাসে সাঁতার কেটে চলেছিল ।
যেতে যেতে,
শূন্যের মেঘলা থেকে যে-রকম উল্কা খসে যায়,
তুমিও সহসা সেই রকম
ঊর্ধাকাশ থেকে এই গৃহস্থবাড়ির বারান্দায়
ছিটকে পড়েছিলে ।।
মূহুর্তে কাকের মেলা বসে গেল ছাতের কার্নিসে ।
কা-কা অট্টহাসির বিদ্রুপে
ভরে উঠল দ্বিপ্রহর ।
তখনও মরোনি তুমি ।দুই চক্ষু
ঘোলাটে ও ঘুর্ণমান,বাদামি শরীর
কেঁপে কেঁপে উঠছে,ফের আকাশে উঠবার
শক্তি নেই,তবু তুমি
শরীরের শেষ বিন্দু সার্মথ্য সংগ্রহ করে
প্রাণপণে ঝাপ্টাচ্ছ ডানা, কখনও-বা
বাঁকিয়ে উদ্ধত গ্রীবা
ঘৃণাভরে দেখে নিচ্ছ
অদূরে অপেক্ষমান শত্রুদের ।।
গগনবিহারী চিল ! যারা উর্ধ্বে উঠতে পারে না, আর
পারে না বলেই যারা
পৃথিবীর
ভাগারে ও আঁস্তাকুড়ে কাপুরুষ মস্তানের মতো
দঙ্গল পাকিয়ে ঘুরে বেড়ায়, তাদের
হাতে কি কখনও আমি ঊর্ধ্বচারী মানুষের
লাঞ্ছনা দেখিনি ?
দেখেছি অসংখ্যবার। বুঝেছি যে,লাঞ্ছনাই স্বাভাবিক ।
এমন কি, লাঞ্ছনা আর নিগ্রহের ফলে
মানুষের দীপ্তি ও মহিমা আরও বেড়ে যায় ।
অথচ সমস্ত দেখে,সমস্ত বুঝেও –মুর্খ আমি—
দলবদ্ধ কাকের গুন্ডামি থেকে
তোমাকে বাঁচাতে গিয়েছিলুম । তোমাকে
বারান্দার থেকে তুলে এনে
স্নানঘরের মধ্যে আটকে রেখে
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভাবতে পেরেছিলুম, তোমার
মর্যাদা বাঁচানো গেল ।।
এখন বুঝতে পারি , বস্তুত তোমাকে
এক বিদ্রুপের থেকে আরও ক্রূর, আর ভয়ংকর
বিদ্রুপের ভিতরে নিক্ষেপ করেছিলুম সেদিন ।
গগনবিহারী চিল,
বৈদুর্যমণির তীব্র দাহনে ঊজ্জ্বল খর দুপুরবেলায়
সম্রাটের মতো তুমি সমস্ত আকাশ ঘুরে এসে
তারপর
শহরতলির এক গৃহস্থের
ছয় বাই তিন ফুট ওই কলঘরের অন্ধকারে বন্দি হয়েছিলে ।
সারারাত্রি ঝাপট মেরেছ তুমি
কাঠের দরজায়,
নখরে আঁচড়েছ মেঝে, সারারাত
আপন সাম্রাজ্য থেকে নির্বাসিত, বিচ্যুত হবার
অপমানে ,গ্লানিতে ও যন্ত্রনায়
চিৎকার করেছ ।।
অমন ধারালো ,শুকনো ,বুকফাটা আর্তনাদ আমি
কখনও শুনিনি ।
মনে হয়েছিল,যেন পাখি নয়,বিশ্ব-চরাচর
আজ রাত্রে ওই
কলঘরের অন্ধকারে বন্দি হয়ে চিৎকার করছে ।
গগনবিহারী চিল,
সকালে তোমাকে আমি মুক্তি দেব বলে
দরজা খুলে যখন দেখলুম,
মেঝের উপরে তুমি স্থির ও নিঃশব্দ হয়ে পড়ে আছ,
তখন আবার মনে হয়েছিল ,
তুমি পাখি নও, তুমি অফুরন্ত আকাশের প্রাণমূর্তি, যেন
সমস্ত আকাশ আজ
নিতান্ত ছাপোষা এক গৃহস্তের
কলঘরের ক্লিন্ন অন্ধকারে
মরে পড়ে আছে ।।
(১৯ ফাল্গুন,১৩৭৬)