কলঘরে চিলের কান্না //নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

এখনও তোমার সেই ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনতে পাই ;

এখনও তোমার সেই দারুণ বিলাপ কানে বাজে ।

গগনবিহারী চিল,

খর দীপ্র দুুপুরবেলায়

তুমি এক আকাশের থেকে অন্য আকাশের দিকে

তেজস্বী ও স্বভাবত-সঙ্গীহিন সম্রাটের মতো

সহজ উল্লাসে

বাতাসে সাঁতার কেটে চলেছিল ।

যেতে যেতে,

শূন্যের মেঘলা থেকে যে-রকম উল্কা খসে যায়,

তুমিও সহসা সেই রকম

ঊর্ধাকাশ থেকে এই গৃহস্থবাড়ির বারান্দায়

ছিটকে পড়েছিলে ।।

মূহুর্তে কাকের মেলা বসে গেল ছাতের কার্নিসে ।

কা-কা অট্টহাসির বিদ্রুপে

ভরে উঠল দ্বিপ্রহর ।

তখনও মরোনি তুমি ।দুই চক্ষু

ঘোলাটে ও ঘুর্ণমান,বাদামি শরীর

কেঁপে কেঁপে উঠছে,ফের আকাশে উঠবার

শক্তি নেই,তবু তুমি

শরীরের শেষ বিন্দু সার্মথ্য সংগ্রহ করে

প্রাণপণে ঝাপ্টাচ্ছ ডানা, কখনও-বা

বাঁকিয়ে উদ্ধত গ্রীবা

ঘৃণাভরে দেখে নিচ্ছ

অদূরে অপেক্ষমান শত্রুদের ।।

গগনবিহারী চিল ! যারা উর্ধ্বে উঠতে পারে না, আর

পারে না বলেই যারা

পৃথিবীর

ভাগারে ও আঁস্তাকুড়ে কাপুরুষ মস্তানের মতো

দঙ্গল পাকিয়ে ঘুরে বেড়ায়, তাদের

হাতে কি কখনও আমি ঊর্ধ্বচারী মানুষের

লাঞ্ছনা দেখিনি ?

দেখেছি অসংখ্যবার। বুঝেছি যে,লাঞ্ছনাই স্বাভাবিক ।

এমন কি, লাঞ্ছনা আর নিগ্রহের ফলে

মানুষের দীপ্তি ও মহিমা আরও বেড়ে যায় ।

অথচ সমস্ত দেখে,সমস্ত বুঝেও –মুর্খ আমি—

দলবদ্ধ কাকের গুন্ডামি থেকে

তোমাকে বাঁচাতে গিয়েছিলুম । তোমাকে

বারান্দার থেকে তুলে এনে

স্নানঘরের মধ্যে আটকে রেখে

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভাবতে পেরেছিলুম, তোমার

মর্যাদা বাঁচানো গেল ।।

এখন বুঝতে পারি , বস্তুত তোমাকে

এক বিদ্রুপের থেকে আরও ক্রূর, আর ভয়ংকর

বিদ্রুপের ভিতরে নিক্ষেপ করেছিলুম সেদিন ।

গগনবিহারী চিল,

বৈদুর্যমণির তীব্র দাহনে ঊজ্জ্বল খর দুপুরবেলায়

সম্রাটের মতো তুমি সমস্ত আকাশ ঘুরে এসে

তারপর

শহরতলির এক গৃহস্থের

ছয় বাই তিন ফুট ওই কলঘরের অন্ধকারে বন্দি হয়েছিলে ।

সারারাত্রি ঝাপট মেরেছ তুমি

কাঠের দরজায়,

নখরে আঁচড়েছ মেঝে, সারারাত

আপন সাম্রাজ্য থেকে নির্বাসিত, বিচ্যুত হবার

অপমানে ,গ্লানিতে ও যন্ত্রনায়

চিৎকার করেছ ।।

অমন ধারালো ,শুকনো ,বুকফাটা আর্তনাদ আমি

কখনও শুনিনি ।

মনে হয়েছিল,যেন পাখি নয়,বিশ্ব-চরাচর

আজ রাত্রে ওই

কলঘরের অন্ধকারে বন্দি হয়ে চিৎকার করছে ।

গগনবিহারী চিল,

সকালে তোমাকে আমি মুক্তি দেব বলে

দরজা খুলে যখন দেখলুম,

মেঝের উপরে তুমি স্থির ও নিঃশব্দ হয়ে পড়ে আছ,

তখন আবার মনে হয়েছিল ,

তুমি পাখি নও, তুমি অফুরন্ত আকাশের প্রাণমূর্তি, যেন

সমস্ত আকাশ আজ

নিতান্ত ছাপোষা এক গৃহস্তের

কলঘরের ক্লিন্ন অন্ধকারে

মরে পড়ে আছে ।।

(১৯ ফাল্গুন,১৩৭৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *