দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি ব’লে এক বাবুসা’ব তারে ঠেলে দিল নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?
যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-সকট চলে,
বাবুসা’ব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে!
বেতন দিয়াছ?–চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল;
কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল!
রাজ-পথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,
রেল পথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,
বল’ত এসব কাহাদের দান!
তোমার অট্টালিকা কার খুনে রাঙা?
ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইঁটে আছে লিখা!
তুমি জান না ক’, কিন্তু পথের প্রতি ধূলিকণা জানে,
ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে!
আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ।
হাতুড়ি শাবল গাঁইতী চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়- কাটা সে পথের দুপাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগালো ধুলি,
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরই গান,
তাদের ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান!
তুমি শুয়ে রবে তেতালার’ পরে আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব সে ভরসা আজ মিছে!
সিক্ত যাদের সারা দেহ- মন মাটির মমতা-রসে,
এই ধরণীর তরণীর হা’ল রবে তাহাদেরি বশে!
তারি পদরজ অঞ্জলি করি’ মাথায় লইব তুলি,
সকলের সাথে পথে চলি যার পায়ে লাগিয়াছে ধুলি!
আজ নিখিলের বেদনা- আর্ত পীড়িতের মাখি’ খুন,
লালে লাল হ’য়ে উদিছে নবীন প্রভাতের নবারুণ!
আজ হৃদয়ের জাম- ধরা যত কবাট ভাঙিয়া দাও,
রং করা ওই চামড়ার যত আবরণ খুলে নাও!
আকাশের আজ যত বায়ু আছে হইয়া জমাট নীল,
মাতামাতি ক’রে ঢুকুক্ এ বুকে, খুলে দাও যত খিল!
সকল আকাশ ভাঙিয়া পড়ুক আমাদের এই ঘরে,
মোদের মাথায় চন্দ্র সূর্য তারারা পড়ুক ঝ’রে
সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি,
এক মোহানায় দাঁড়াইয়া শুনো এক মিলনের বাঁশী।
একজন দিলে ব্যথা
সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা!
একের অসম্মান
নিখিল মানবজাতির লজ্জা-সকলের অপমান!
মহা-মানবের মহা বেদনার আজি মহা- উত্থান,
ঊর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নিচে কাঁপিতেছে শয়তান!
(সর্বহারা, ১৩৩১– ‘৩৩)