“গল্প বলবে”-কাহিনী: সুকুমার রায়//নাট্যরুপ ও সংযোজনা-পিয়ালী দাস অধিকারী[ ‘galpo bolbe’]

[music বাজে,আস্তে আস্তে পর্দা ওঠে,গান শুরু হয়।]
গান: – সুকুমার ঝুলি এইবার খুলবে
শোনো শোনো ছোটরা গল্প বলবে
সুকুমার ঝুলি খুলবে, তোমরা গল্প শুনবে।
সুকুমার ঝুলি খুলবে, সবাই গল্প শুনবে।।
গা ছমছম কি হয় কি হয়, কখনো মজার কখনো বা ভয়…(ছেলে ও মেয়েরা সকলে মিলে গান করে)
সকলে: হি হি হি! কি মজা, কি মজা,
চল চল আমরা গল্প বলি, গল্প শুনি।

কবিতা: (সমবেত কবিতা)
ছেলেরা: আমরা ভালো লক্ষ্মী সবাই, তোমরা ভারি বিশ্রী,
মেয়েরা: তোমরা খাবে নিমের পাঁচন আমরা খাবো মিশ্রি।
ছেলেরা: আমরা পাব খেলনা পুতুল, আমরা পাবো চমচম্
তোমরা তো তা পাচ্ছ না কেউ, পেলেও পাবে কম্ কম্।
মেয়েরা: আমরা শোবো খাট্ পালঙে মায়ের কাছে ঘেঁষটে,
তোমরা শোবে অন্ধকারে একলা ভয়ে ভেস্তে।
ছেলেরা: আমরা যাব জাম্ তাড়াতে চড়বো কেমন ট্রেইনে,
চেঁচাও যদি ” সঙ্গে নে যাও” বলব্ ‘কলা এই নে! ‘
আমরা ফিরি বুক ফুলিয়ে রঙিন্ জুতোয় মচমচ্
মেয়েরা: তোমরা হাঁদা নোংরা ছি ছি! হ্যাংলা নাকে ফঁচ্ ফঁচ্।
আমরা পরি রেশমি জরি, আমরা পরি গয়না,
তোমরা সেসব পাওনা ব’লে তাও তোমাদের সয় না।
ছেলে: আমরা হব লাট মেজাজি, তোমরা হবে কিপটে,
চাইবে যদি কিচ্ছু, তখন ধরবো গলা চিপটে।।

গল্প শুরু:
প্রথম: আমি ভাই একটা স্বপ্ন দেখেছি- এমন মজার!
দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ ও পঞ্চম:–কি রে- কি স্বপ্ন ?বল না রে-
প্রথম: না ভাই, আমি ঐ ওকে বলবো না– ও ভারি হিংসুটে।
পঞ্চম: আচ্ছা, নাই বা বললি । ভারি তো স্বপ্ন- আমি বুঝি আর স্বপ্ন দেখতে জানিনে–
প্রথম: দেখলে তো, কি রকম হিংসে!
দ্বিতীয়, তৃতীয়: আচ্ছা ওকে নাইবা বললি আমাদের বল না।
চতুর্থ: আর না হয় ও শুনলই বা- তাতে দোষ কি ?
পঞ্চম: আমার বয়ে গেছে –ও ছাই স্বপ্ন আমি একটুও শুনতে চাই না।
প্রথম: শুনলি তো! কিরকম হিংসে করে করে কথা কয় ?আমি কি ওকে শুনতে বলেছি?
চতুর্থ: কিসের স্বপ্ন ?– রাজহাঁসের?
প্রথম: দুৎ! রাজহাঁসের স্বপ্নকে বুঝি মজার স্বপ্ন বলে?
চতুর্থ :রাজহাঁসের স্বপ্ন খুব মজার হয় ।আমি যখন রাজহাঁসদের সঙ্গে মেঘের মধ্যে ভাসছিলাম ,তখন নীল নীল ঢেউগুলো সব আমার গায়ে লাগছিল ,আর তারা গুলো সব ফুটেছিল,ঠিক যেন পদ্ম ফুলের মত। আমার খুব মজা লাগছিল।
পঞ্চম: তুই সেখানে দোলনা-দেওয়া লাল ফুলের বাগান দেখেছিলি? আর পেখম ধরা ময়ূর দেখেছিলি?
চতুর্থ: কই, না তো!
পঞ্চম: আমি দেখেছিলাম। ময়ূরদের পায়ে সোনার ঘুঙুর এমন সুন্দর বাজছিল।!–এমন সময় হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল, শুনলাম সকালবেলায় বোর্ডিংয়ের ঘন্টা বাজছে।
(সকলে মিলে হাসি)
প্রথম :দেখ্লি , আমি একটা কথা বলতে যাচ্ছিলুম, এর মধ্যে কি রকম বকবক করতে লেগেছে! ওরা ইচ্ছে করে আমায় বলতে দেবে না।
দ্বিতীয় ও তৃতীয়: আহা! তোরা একটু থাম না বাপু–
প্রথম: আবার কিন্তু ওরকম করলে আমি কক্ষনো বলবো না।
দ্বিতীয় ,তৃতীয় ও চতুর্থ: না না, কেউ বাধা দেব না–বল্।
প্রথম :আমি স্বপ্ন দেখেছি–ওই বাগানের মধ্যে একটা মেলা হচ্ছে। আমি সেই মেলায় গিয়েছি, আর সেখানে এক মেম সকলকে পুতুল দিচ্ছে। ঠিক এত্তো বড় বড় পুতুল!–তার জন্য পয়সা নিচ্ছে না।
আমায় একটা পুতুল দিল, তার মাথা ভরা কোঁকড়া চুল, এমনি মোটা মোটা গাল, আর ঠিক সত্যিকারের মানুষের মতন কথা বলে।
দ্বিতীয় ,তৃতীয় ও চতুর্থ: ও-মা! কি চমৎকার!
তৃতীয়: হাত পা নাড়তে পারে?
চতুর্থ :নিজে নিজে চলতে পারে?
দ্বিতীয় :আসতে পারে?
প্রথম: হ্যাঁ ,আসতে পারে, খেলতে পারে, সব পারে।
পঞ্চম: সত্যিকারের মানুষের মতন তৈরি?
দ্বিতীয় :কেন -এখন যে বড় কথা বলতে এসেছিস?
তৃতীয় :তবে যে বলছিলি ছাই স্বপ্ন, তুই একটুও শুনতে চাস না।
চতুর্থ: তা কেন, তোরাই তো ওকে শুনতে দিচ্ছিলি না।
প্রথম :বেশ করেছি। ও কেন কথায় কথায় হিংসে করে? তারপর শোন, সবাইকে পুতুল দিল, কিন্তু কারো পুতুল ওরকম কথাও কয় না ,খেলাও করে না–
চতুর্থ: এমা!
প্রথম: আর ওই ও একটা পুতুল পেয়েছিল, নোংরা কালো দাঁতভাঙ্গা, বিচ্ছিরি মতন।
(সবাই হাসে)
পঞ্চম: ইস! তা বৈকি! নিজের বেলায় সব ভালো ভালো, আর পরের বেলায় সব নোংরা আর ময়লা আর বিচ্ছিরি !
প্রথম: দেখলি , কি রকম হিংসে করে করে বলছে ,মেম সাহেব ওরকম দিয়েছে, তা আমি কি করবো বল?
তৃতীয় :হ্যাঁ ,তাছাড়া এ তো সত্যি নয়- স্বপ্ন!
দ্বিতীয়: স্বপ্ন নিয়ে আবার হিংসে কি? ছিঃ ছিঃ!
চতুর্থ: হ্যাঁ– তারপর কি হলো বল্ না?
প্রথম: তারপর সে পুতুল নিয়ে কত মজা হলো, সব আমার মনেও নেই। শেষে কিন্তু ভাই আমার ভারি কষ্ট হয়েছিল।


দ্বিতীয় তৃতীয় ও চতুর্থ: কেন কি হয়েছিল?
প্রথম: সে ভাই বলব কি- পুতুলটাকে সবাই নিয়ে দেখছে, দেখছে ,হঠাৎ দেখি পুতুলটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
চতুর্থ: এ মা!
প্রথম: আমার এমন কান্না পেতে লাগলো ..
দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ: কি করে ভাঙলো রে?
প্রথম: কি জানি, কি করে! আমার মনে হয় নিশ্চয়ই ওই হিংসুটেটা কখন হিংসে করে ভেঙ্গে দিয়েছিল!
পঞ্চম: মাগো ,এমন বানিয়ে বানিয়ে বলতে পারে আমার নামে!
প্রথম :তা বৈকি! যারা হিংসুটে তারা স্বপ্নেও হিংসুটে হয়।
দ্বিতীয়: হয় না তো কি? নিশ্চয়ই হয়– হিংসুটে! হিংসুটে!
তৃতীয়: কিন্তু আমি যেদিন স্বপ্নে পথ হারিয়েছিলাম ,সেদিন ও আমায় পথ্ বলে দিয়েছিল।
চতুর্থ: কি করে পথ হারিয়েছিলি রে?
তৃতীয় :সেই একটা বাগানের মধ্যে এক বুড়ি একটা কাঠি ছুঁয়ে ছুঁয়ে সবাইকে পাথর করে
দিচ্ছিল, আর আমি কিছুতেই পালাবার পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তারপর ও এসে আমায় একটা লুকানো পথ দেখিয়ে দিল। সেইখান দিয়ে আমরা পালিয়ে গেলাম।
চতুর্থ: তবুও ওরা ওকে হিংসুটে বলে? আচ্ছা, তুই বুঝি খালি ময়ূরের স্বপ্ন দেখিস?
পঞ্চম: না- সে খালি একদিন দেখেছিলাম। অন্য সময়ে আমি আলতামাসির স্বপ্ন দেখি।
তৃতীয় চতুর্থ :আলতা মাসি কে রে?
পঞ্চম :সে আমার একজন মাসি হয়। তার কেউ নেই কিনা? সব মরে গেছে। তাই সে রোজ রোজ কাঁদে।
চতুর্থ: আহা রে!
পঞ্চম: আমি স্বপ্ন দেখি, আলতা মাসির খোকাকে কত করে খুঁজছি কিন্তু কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না, আর আলতা মাসির চোখ দিয়ে শুধু জল পরছে।
প্রথম :দেখলি দেখ্লি, আমার দেখাদেখি ও আবার স্বপ্ন বলতে লেগেছে ।এমন হিংসুটে!
দ্বিতীয়: উফ !আমার ভাই বড় ঘুম পাচ্ছে!
তৃতীয় চতুর্থ :সত্যি আমারও।
প্রথম :আমারও ঘুম পেয়ে গেল।
পঞ্চম: হ্যাঁ তাইতো চোখ বুজে আসছে যে!

(সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, আলো নেভে, স্বপ্নের রাজ্যে চলে যায়। music বাজে–স্বপ্নের দেশে]
গান (মেয়েরা):”ঘুম যায় ওই চাঁদ মেঘ পরীদের সাথে
গল্প শোনার পালা এবার নিঝুম নিশি রাতে।।
এক যে আছে স্বপনপুরী নেইকো সেথায় হাসি
মালঞ্চে নেই ফুলের বাহার মন যে উদাসী।
(ছেলে): এমন সময় ডালিমকুমার এলো বাঁশি হাতে।
গল্প শোনার পালা এবার নিঝুমনিশি রাতে।।”

পরীদের নাচ: (দুজন মিলে)
দ্বিতীয়: ঠিক যেন স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে না!
চতুর্থ : হ্যাঁ –সত্যি হচ্ছে কি স্বপ্ন হচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।[স্টেজের এক কোনে দৈত্যের চেহারার একজন দাঁড়িয়ে]
তৃতীয়: ও মা !ও কে ? ওই যে দাঁড়িয়ে আছে?
চতুর্থ ও দ্বিতীয়: ম্যাগো! কি বিশ্রী চেহারা!
ঈর্ষাজিন: দেখ্ তো আমায় চিনিস কিনা?
প্রথম: হ্যাঁ- কোথায় দেখেছি মনে নেই, কিন্তু চেনা চেনা লাগছে।
পঞ্চম: তুই কোথায় থাকিস ভাই?
ঈর্ষাজিন: তাও জানিস নে? এইতো তোদের মনের মধ্যেই থাকি।
প্রথম: মনের মধ্যে থাকে, সে আবার কি রকম ভাই? সেখানে কি থাকবার জায়গা আছে?
ঈর্ষাজিন: হ্যাঁ, আছে বৈকি? ঘর ,বাগান, জল মাটি ,আকাশ সব আছে।
পঞ্চম :তাই নাকি ?তোর নাম কি ভাই?
ঈর্ষাজিন: আমার নাম ঈর্ষাজিন, হিংসুটেদের মনের মধ্যে যে থাকে সেই ঈর্ষাজিন।
তৃতীয় চতুর্থ ও দ্বিতীয় (একসাথে কবিতা বলে ):
কবিতা: (হিংসে হাসি চিমসে বাঁকা–
কাল কুটকুট গরল মাখা।)
গান (ছেলে মেয়ে উভয়): হিংসে হাসি চিমসে বাঁকা কাল কুটকুট গরল মাখা।

পঞ্চম: কি সুন্দর কালো কালো হাত দেখেছিস।
প্রথম: হ্যাঁ আবার মুখে কি সুন্দর রংবেরঙের কাজ করেছে।
চতুর্থ : ম্যাগো! ওকে আবার সুন্দর বলছে।
তৃতীয় ও দ্বিতীয় :এমন কুৎসিত ছ্যাঃ!
প্রথম: আচ্ছা ভাই ,যারা হিংসুটে তারা বুঝি খুব দুষ্টু?
ঈর্ষাজিন : হ্যাঁ, দুষ্টু বই কি? দুষ্টু আর ঝগড়াটে।
প্রথম :কথায় কথায় বুঝি রাগ করে?
ইরসাজিন: হ্যাঁ নিজেরা রাগ করে আর অন্যদের বলে হিংসুটি।
পঞ্চম :অন্যদের ভালো দেখতে পারে না, না?
ঈর্ষাজিন: এক্কেবারেই পারে না। এমনিও পারেনা, স্বপ্নেও পারে না।
প্রথম :ঠিক ওই ওর মত?
পঞ্চম: আচ্ছা ভাই ,তুই হিংসুটেদের মনের মধ্যে থাকিস কেন?
ইরশাজিন: বাঃ!তা না হলে থাকবো কোথায়? তোদের মনের মধ্যে যেখানে কালো কালো ঝুল মাখানো পর্দা ঝোলে, সেখানে ছ্যাঁক ছ্যেঁকে আগুন জ্বেলে বসি। আর কাটা কাটা ঝাল ঝাল কথা বানিয়ে খাই।
তৃতীয় চতুর্থ ও দ্বিতীয়: কি ভয়ানক দুষ্টু!
ইর্ষাজিন: দেখলি? ওরা আমাকে দুষ্টু বলছে, বিশ্রী বলছে তাই ওদের কাছে আমি একটুও ঘেসি না। আর তোরা আমায় লক্ষী বলিস, মনের মধ্যে আদর করে পুষে রাখিস ,তাই তোদের সঙ্গে আমার কত ভাব।
প্রথম :দেখলে ভাই কেমন মিষ্টি করে করে কথা বলছে?
পঞ্চম: দেখলি আমাদের কত ভালবাসে, আর ওদের একটুও ভালোবাসে না।
ইর্ষাজিন: তাহলে এখন আসি ভাই, মনে থাকবে তো ,এই আমার ছাপ রেখে গেলাম।

(ইর্ষাজিন ছাপ দিয়ে চলে যায়, স্বপ্ন ভাঙে সকলের)[আবার বাস্তব জগৎ]
তৃতীয় :ও মা !কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি মনেও নেই।
চতুর্থ :কি যে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি, সেই ঈর্ষাজিন বলে একজন কে আছে–
দ্বিতীয়: কি আশ্চর্য! আমিও ঠিক তাই দেখেছি, ওদের সঙ্গে তার কত ভাব।
তৃতীয়: হ্যাঁ হ্যাঁ ওদের মনের মধ্যে থাকে।
চতুর্থ :আর ঝাল ঝাল কথা খায়।
প্রথম: ও কি ভাই !তোর গালে অমন দাগ দিয়ে গেল কে?
পঞ্চম: ও মা! তোর গালেও দেখছি ছাপ।
তৃতীয় চতুর্থ: ও কি সত্যি সত্যি ছাপ দিয়ে গেছে?
সকলে মিলে: কি দুষ্টু! কি দুষ্টু! কি দুষ্টু!
প্রথম :আবার বলে, আমাদের সঙ্গে ভাব করবে।
পঞ্চম :কক্ষনো না,আর কোনদিন ভাব করব না।
প্রথম :এমনিও করবো না, স্বপ্নেও করব না।
সকলে মিলে: কক্ষনো না, কক্ষনো না, কক্ষনো না।
(পিছনে দৈত্যকে দেখা যায়, শিশুরা মিলে মারে)।

// নমস্কার//
[১) আমরা সমাজের ঈর্ষার চূড়ান্ত দানবীয়তার অবসান চাই।
২) ঈর্ষা নিপাত যাক–We shall over come
3) হিংসা নয় ,ভালোবাসাই মুক্তির পথ।
৪) The truth will make us free.
(এই পাঁচটি প্ল্যাকার্ড হাতে করে শেষে ছোটরা স্টেজে দাঁড়ায়)]