সাম্যের গান গাই—
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই !
বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যান-কর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,অর্ধেক তার নর !
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ তাপ বেদনা অশ্রুবারি
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর ,অর্ধেক তার নারী !
নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা ,করে নারী হেয়-জ্ঞান?
তারে বল,আদি-পাপ নারী নহে,সে যে নর-শয়তান।
অথবা পাপ যে–শয়তান যে–নর নহে নারী নহে,
ক্লীব সে,তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে !
এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল ফলিয়াছে যত ফল,
নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।
তাজমহলের পাথর দেখেছ,দেখিয়াছ তার প্রাণ?
অন্তরে তার মোমতাজ নারী,বাহিরেতে শা-জাহান !
জ্ঞানের লক্ষী ,গানের লক্ষী,শস্য-লক্ষী নারী,
সুষমা-লক্ষী নারীই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারি ।
পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ,
কামিনী এনেছে যামিনী-শান্তি,সমীরণ,বারিবাহ !
দিবসে দিয়াছে শক্তি-সাহস ,নিশীথে হয়েছে বধূ,
পুরুষ এসেছে মরুতৃষা ল’য়ে —নারী যোগায়েছে মধু !
শষ্যক্ষেত্র উর্বর হ’ল পুরুষ চালাল হল;
নারী সেই মাঠে শষ্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল।
নর বাহে হল,নারী বহে জল,সেই জল-মাটি মিশে
ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালী ধানের শীষে ।।
স্বর্ণ-রৌপ্যভার
নারীর অঙ্গ-পরশ লভিয়া হ’য়েছে অলঙ্কার !
নারীর বিরহে,নারীর মিলনে ,নর পেল কবি-প্রাণ,
যত কথা তার ,হইল কবিতা ,শব্দ হইল গান ।
নর দিল ক্ষুধা,নারী দিল সুধা ,সুধায় ক্ষুধায় মিলে
জন্ম লভিছে মহামানবের মহাশিশু তিলে তিলে !
জগতের যত বড় বড় জয়,বড় বড় অভিযান,
মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান্।
কোন্ রণে কত খুন দিল নর লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর লেখা নাই তার পাশে !
কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি’,কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা ?
কোনো কালে একা হয় নি ক’জয়ী পুুরুষের তরবারী
প্রেরণা দিয়াছে,শক্তি দিয়াছে ,বিজয়-লক্ষী নারী !
রাজা করিয়াছে রাজ্য-শাসন,রাজারে শাসিল রাণী,
রাণীর দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্লানি !
পুরুষ হৃদয়-হীন,
মানুষ করিতে নারী দিল তারে আধেক হৃদয় ঋণ ।
ধরায় যাঁদের যশ ধরে না ক’অমর মহামানব,
বরষে বরষে যাঁদের স্মরণে করি মোরা উৎসব,
খেয়ালের বশে তাঁদের জন্ম দিয়াছে বিলাসী পিতা–
লব কুশে বনে ত্যজিয়াছে রাম,পালন করেছে সীতা !
নারী সে শিখাল শিশু-পুরুষেরে স্নেহ প্রেম দয়া মায়া,
দীপ্ত নয়নে পরাল কাজল বেদনার ঘন ছায়া ।
অদ্ভুত রূপে পরুষ পুরুষ করিল সে ঋণ শোধ,
বুকে ক’রে তারে চুমিল যে,তারে করিল সে অবরোধ !
তিনি নর-অবতার —
পিতার আদেশে জননীরে যিনি কাটেন হানি’ কুঠার!
পার্শ্ব ফিরিয়া শুয়েছেন আজ অর্ধনারীশ্বর,
নারী চাপা ছিল এতদিন,আজ চাপা পড়িয়াছে নর !
সে যুগ হ’য়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’,নারীরা আছিল দাসী !
বেদনার যুগ,মানুষের যুগ,সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী,কাহারও উঠিছে ডঙ্কা বাজি,
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী,তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে !
যুগের ধর্ম এই–
পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই !
শোনো মর্তের জীব,
অন্যেরে যত করিবে পীড়ন,নিজে হবে তত ক্লীব !
স্বর্ণ-রৌপ্য অলঙ্করের যক্ষপুরীতে নারী,
করিল তোমায় বন্দিনী,বলো কোন্ সে অত্যাচারি ?
আপনারে আজ প্রকাশের তব নাই সেই ব্যাকুলতা,
আজ তুমি ভীরু আড়ালে থাকিয়া নেপথ্যে কও কথা !
চোখে চোখে আজি চাহিতে পার না; হাতে রুলি,পায়ে মল,
মাথার ঘোমটা ছিঁড়ে ফেল নারী,ভেঙে ফেল ও শিকল !
যে ঘোমটা তোমা’ করিয়াছে ভীরু ওড়াও সে আভরণ !
দুর ক’রে দাও দাসীর চিহ্ন আছে যত আভরণ !
ধরার দুলালী মেয়ে,
ফির’না ত আর গিরিদরীবনে শাখী-সনে গান গেয়ে !
কখন্ আসিল ‘প্লুটো’ যমরাজা নিশীথ পাখায় উ’ড়ে,
ধরিয়া তোমায় পূরিল তাহার আঁধার বিবর-পুরে !
সেই সে আদিম বন্ধন তব,সেই হ’তে আছ মরি’
মরণের পুরে ;নামিল ধরায় সেইদিন বিভাবরী।
ভেঙে যমপুরী নাগিনীর মত আয় মা পাতাল ফুঁড়ি !
আধাঁরে তোমায় পথ দেখাবে মা তোমারি ভগ্ন চুড়ি !
পুরুষ যমের ক্ষুধার কুকুর মুক্ত ও-পদাঘাতে
লুটায়ে পড়িবে ও চরণ-তলে দলিত যমের সাথে !
এতদিন শুধু বিলালে অমৃত, আজ প্রয়োজন যবে
যে-হাতে পিয়ালে অমৃত,সে হাতে কূট বিষ দিতে হবে!
সে-দিন সুদূর নয়–
যে-দিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয় ! ।।।
[সাম্যবাদী]