নারী-কাজী নজরুল ইসলাম [NARI-KAZI NAZRUL IISLAM ]

সাম্যের গান গাই—

আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই !

বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যান-কর

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,অর্ধেক তার নর !

বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ তাপ বেদনা অশ্রুবারি

অর্ধেক তার আনিয়াছে নর ,অর্ধেক তার নারী !

নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা ,করে নারী হেয়-জ্ঞান?

তারে বল,আদি-পাপ নারী নহে,সে যে নর-শয়তান।

অথবা পাপ যে–শয়তান যে–নর নহে নারী নহে,

ক্লীব সে,তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে !

এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল ফলিয়াছে যত ফল,

নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।

তাজমহলের পাথর দেখেছ,দেখিয়াছ তার প্রাণ?

অন্তরে তার মোমতাজ নারী,বাহিরেতে শা-জাহান !

জ্ঞানের লক্ষী ,গানের লক্ষী,শস্য-লক্ষী নারী,

সুষমা-লক্ষী নারীই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারি ।

পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ,

কামিনী এনেছে যামিনী-শান্তি,সমীরণ,বারিবাহ !

দিবসে দিয়াছে শক্তি-সাহস ,নিশীথে হয়েছে বধূ,

পুরুষ এসেছে মরুতৃষা ল’য়ে —নারী যোগায়েছে মধু !

শষ্যক্ষেত্র উর্বর হ’ল পুরুষ চালাল হল;

নারী সেই মাঠে শষ্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল।

নর বাহে হল,নারী বহে জল,সেই জল-মাটি মিশে

ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালী ধানের শীষে ।।

স্বর্ণ-রৌপ্যভার

নারীর অঙ্গ-পরশ লভিয়া হ’য়েছে অলঙ্কার !

নারীর বিরহে,নারীর মিলনে ,নর পেল কবি-প্রাণ,

যত কথা তার ,হইল কবিতা ,শব্দ হইল গান ।

নর দিল ক্ষুধা,নারী দিল সুধা ,সুধায় ক্ষুধায় মিলে

জন্ম লভিছে মহামানবের মহাশিশু তিলে তিলে !

জগতের যত বড় বড় জয়,বড় বড় অভিযান,

মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান্।

কোন্ রণে কত খুন দিল নর লেখা আছে ইতিহাসে,

কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর লেখা নাই তার পাশে !

কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি’,কত বোন দিল সেবা,

বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা ?

কোনো কালে একা হয় নি ক’জয়ী পুুরুষের তরবারী

প্রেরণা দিয়াছে,শক্তি দিয়াছে ,বিজয়-লক্ষী নারী !

রাজা করিয়াছে রাজ্য-শাসন,রাজারে শাসিল রাণী,

রাণীর দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্লানি !

পুরুষ হৃদয়-হীন,

মানুষ করিতে নারী দিল তারে আধেক হৃদয় ঋণ ।

ধরায় যাঁদের যশ ধরে না ক’অমর মহামানব,

বরষে বরষে যাঁদের স্মরণে করি মোরা উৎসব,

খেয়ালের বশে তাঁদের জন্ম দিয়াছে বিলাসী পিতা–

লব কুশে বনে ত্যজিয়াছে রাম,পালন করেছে সীতা !

নারী সে শিখাল শিশু-পুরুষেরে স্নেহ প্রেম দয়া মায়া,

দীপ্ত নয়নে পরাল কাজল বেদনার ঘন ছায়া ।

অদ্ভুত রূপে পরুষ পুরুষ করিল সে ঋণ শোধ,

বুকে ক’রে তারে চুমিল যে,তারে করিল সে অবরোধ !

তিনি নর-অবতার —

পিতার আদেশে জননীরে যিনি কাটেন হানি’ কুঠার!

পার্শ্ব ফিরিয়া শুয়েছেন আজ অর্ধনারীশ্বর,

নারী চাপা ছিল এতদিন,আজ চাপা পড়িয়াছে নর !

সে যুগ হ’য়েছে বাসি,

যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’,নারীরা আছিল দাসী !

বেদনার যুগ,মানুষের যুগ,সাম্যের যুগ আজি,

কেহ রহিবে না বন্দী,কাহারও উঠিছে ডঙ্কা বাজি,

নর যদি রাখে নারীরে বন্দী,তবে এর পর যুগে

আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে !

যুগের ধর্ম এই–

পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই !

শোনো মর্তের জীব,

অন্যেরে যত করিবে পীড়ন,নিজে হবে তত ক্লীব !

স্বর্ণ-রৌপ্য অলঙ্করের যক্ষপুরীতে নারী,

করিল তোমায় বন্দিনী,বলো কোন্ সে অত্যাচারি ?

আপনারে আজ প্রকাশের তব নাই সেই ব্যাকুলতা,

আজ তুমি ভীরু আড়ালে থাকিয়া নেপথ্যে কও কথা !

চোখে চোখে আজি চাহিতে পার না; হাতে রুলি,পায়ে মল,

মাথার ঘোমটা ছিঁড়ে ফেল নারী,ভেঙে ফেল ও শিকল !

যে ঘোমটা তোমা’ করিয়াছে ভীরু ওড়াও সে আভরণ !

দুর ক’রে দাও দাসীর চিহ্ন আছে যত আভরণ !

ধরার দুলালী মেয়ে,

ফির’না ত আর গিরিদরীবনে শাখী-সনে গান গেয়ে !

কখন্ আসিল ‘প্লুটো’ যমরাজা নিশীথ পাখায় উ’ড়ে,

ধরিয়া তোমায় পূরিল তাহার আঁধার বিবর-পুরে !

সেই সে আদিম বন্ধন তব,সেই হ’তে আছ মরি’

মরণের পুরে ;নামিল ধরায় সেইদিন বিভাবরী।

ভেঙে যমপুরী নাগিনীর মত আয় মা পাতাল ফুঁড়ি !

আধাঁরে তোমায় পথ দেখাবে মা তোমারি ভগ্ন চুড়ি !

পুরুষ যমের ক্ষুধার কুকুর মুক্ত ও-পদাঘাতে

লুটায়ে পড়িবে ও চরণ-তলে দলিত যমের সাথে !

এতদিন শুধু বিলালে অমৃত, আজ প্রয়োজন যবে

যে-হাতে পিয়ালে অমৃত,সে হাতে কূট বিষ দিতে হবে!

সে-দিন সুদূর নয়–

যে-দিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয় ! ।।।

[সাম্যবাদী]