অজীবকে ভালোবাস – পিয়ালী দাস অধিকারী

হ্যাঁ অজীবকে ভালোবাস, কোন জীবকে নয়,

যে ভালোবাসা তোমাকে তোমার মতো করে বাঁচতে শেখাবে।

যার প্রাণ নেই কিন্তু তুমি তার অস্তিত্বকে টের পাও।

যে ছোট থেকে বড়ো হয় না

তবু তুমি তার আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠা অনুভব করো।

সে স্থানান্তরিত হয় না

অথচ তুমি তাকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে পার ।

যার বাহ্যিক রূপ নে‌ই কিন্তু

তুমি তাকে নানা রূপে সাজাতে পারো।

তুমি ভালোবাস সেই অদেখা’কে

যাকে তুমি তোমার মনের চোখ দিয়ে দেখতে পারো,

যার হাত ধরে দীর্ঘ সময় আনন্দে কাটাতে পারো ।

তোমার ছো্ট্ট সংসারের কাজের মধ্যে থেকে

তুমি তাকে নানা রূপে রূপ দিতে পারো ।।

ভোরবেলায় ব্রহ্মমূহুর্তে তুমি তাকে

এক স্বর্গীয় রূপে পেতে পারো —ওঁম——

সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে

ভৈরবের সুরে তাকে একটু স্পর্শ করতে পারো —

“উঠত বাজ মুরলী আজ “(সংগীত) ।

বাজারের থলি নিয়ে মেঠো পথে যেতে যেতে

তাকে টাক্ডুমডুম ছন্দের গতি দিতে পারো—–

“ধাগেতেটে ধাগেতেটে তাগেতেটে তাগেতেটে

ক্রেধাতেটে ধাগেতেটে গদিঘেনে নাগেতেটে

ক তেটে,তা গেনে,ধাগে তেটেকতা গদিঘেনে

গদিঘেনে ধা,গদি ঘেনে ধা গদিঘেনে ।।”ধা (তবলার বোল)

মিউজিক রুমে তুমি তাকে ক্রিয়েটিভ রূপ দিতে পারো —-

“স প সরগমপ

র প রগমপ

গ প গমপ

ম প মপ

প ।।

প স পমগরস

ম স মগরস

গ স গরস

র স রস

স ।।” (সংগীত)

অফিসের কাজের ফাঁকে

তুমি তাকে ভ্রমরের সুরে

চুপিচুপি কাছে পেতে পারো —

“তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার ” (সংগীত)

পড়ন্ত বিকেলে ইমনের আবেশে তাকে রাঙিয়ে তুলতে পারো—–

“পিয়া কি নজরিয়া,

য়াদু ভরি মোহলিও মন

প্রেম একভরি ।”(সংগীত) ।।

সন্ধ্যায় পূজা রুমে বসে রামপ্রসাদী সুরে

তাকে এক আধ্যাত্মিক রূপ দিতে পারো —

“আমি শুধু রইনু বাকি

যা ছিল তা গেল চলে

রইল যা তা কেবল ফাঁকি ।।”(সংগীত) ।।

তারপর কলম হাতে কবিসত্বায়

তার জাগরণ ঘটাতে পারো —-

“তুমি কি কেবলই ছবি

শুধু পটে লিখা ।

ওই যে সুদূর নীহারিকা

যারা করে আছে ভিড় আকাশের নীড়,

ওই যারা দিনরাত্রি

আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী

গ্রহ তারা রবি ,

তুমি কি তাদের মতো সত্য ন‌ও ,

হায় ছবি,তুমি শুধু ছবি ।।”(রবীন্দ্রসংগীত) ।।

সেই তাকেই তুমি ভালোবাস

সেই তোমার অজীব ভালোবাসা

তোমার বন্ধু ,তোমার প্রেমিক

তোমার মানষিক আশ্রয়,তোমার জীবনসাথী ।

যাকে হারানোর ভয় তোমার নেই

তাকেই ভালোবাস তুমি ।

যাকে হারালে ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রনা পেতে হবে না ।

একা ঘরে বসে ডুকরে ডুকরে

কেঁদে মরতে হবে না ।

সকালে একা চায়ের কাপে

চুমুক দেওয়াটা হবে না।

দুপুরে ভাতের থালা নিয়ে মুখ বুজে

আড়ালে চোখের জল মুছতে হবে না ।

যাকে হারালে ,একান্ত মনের না বলা কথা

ছটফট করে পুড়ে মরবে না ।

যাকে হারালে‌ ,একা ঘরে বসে

একাকিত্বের নিদারুন যন্ত্রনা পেতে হবে না ।

যাকে হারালে মিউজিক রুমে তবলাটা

না ধরার কষ্টটা পেতে হবে না ।

যাকে হারালে পরশির থেকে “তুমি তো খুব স্ট্রং”

এই কমপ্লিমেন্টটা পাওয়া হবে না ।

যাকে হারালে ,”পূ্র্বজন্মের কোন পাপের ফল “

এই তথাকথিত চলে আসা বাণীটি

তোমার অন্তরে ছুড়ি বসাবে না ।

যাকে হারালে ,দিনের পর দিন মূর্তি ভগবানের দ্বারে

প্রিয়ের প্রাণভিক্ষা চাইতে হবে না ।

ঘরে রাখা পুতুল ভগবানের মূর্তি আর

ডিভানে সরাতে হবে না ।

যাকে হারালে ,প্রতিরাতে ছোট্ট মেয়েটির

পিতার মুখাগ্নি করার ভয়ঙ্কর দৃশ্যটি

আতঙ্কের রূপ নেবে না ।

যাকে হারালে অবুঝ মেয়ের মায়ের নামের আগে

“উইডো”শব্দটি লিখতে হাতটি কেঁপে উঠবে না ।

সেই হোক তোমার জীবনসাথী,

যাকে হারালে সন্তানকে একা বড়ো করার

ভয় মনে জেগে উঠবে না ।

যাকে হারালে সন্তানের অ্যাচিভমেন্টের আনন্দ

ভাগ করে না নেওয়ার যন্ত্রনা পেতে হবে না ।

সেই হোক তোমার ভালোবাসা ,

যাকে হারালে একা সজ্জায় বিনিদ্ররাত জাগতে হবে না।

যাকে হারালে মধ্যগগণে সূযার্স্তের রূপ

তোমার উপলব্ধি করতে হবে না ।

সেই সেই সেই হোক

তোমার বন্ধু,তোমার প্রেমিক , তোমার আশ্রয়

তোমার ভালোবাসা‌‌ ,তোমার জীবনসাথী ,

তোমার বাঁচার একমাত্র আলো

তোমার সংগীত ।।