হঠাৎ-দেখা / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা,

ভাবি নি সম্ভব হবে কোনোদিন ।।

আগে ওকে বারবার দেখেছি

লাল রঙের শাড়িতে—-

দালিম-ফুলের মতো রাঙা ;

আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়,

আঁচল তুলেছে মাথায়

দোলন-চাঁপার মতো চিকন-গৌর মুখখানি ঘিরে ।

মনে হল , কালো রঙে একটা গভীর দূরত্ব

ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চারদিকে,

যে দূরত্ব সর্ষেক্ষেতের শেষ সীমানায়

শালবনের নীলাঞ্জনে ।

থমকে গেল আমার মনটা

চেনা লোককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে ।।

হঠাৎ খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে

আমাকে করলে নমস্কার ।

সমাজবিধির পথ গেল খুলে ;

আলাপ করলেম শুরু—

” কেমন আছ ,’ কেমন চলছে সংসার’ ইত্যাদি ।

সে রইল জানলার বাইরের দিকে চেয়ে

যেন কাছের-দিনের-ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে ।

দিলে অত্যন্ত ছোটো দুটো-একটা জবাব,

কোনোটা বা দিলেই না

বুঝিয়ে দিলে হাতের অস্থিরতায়—

কেন এ-সব কথা,

এর চেয়ে অনেক ভালো চুপ ক’রে থাকা ।।

আমি ছিলেম অন্য বেঞ্চিতে ওর সাথিদের সঙ্গে ।

এক সময়ে আঙুল নেড়ে জানালে কাছে আসতে ।

মনে হল কম সাহস নয়—

বসলুম ওর এক-বেঞ্চিতে ।

গাড়ির আওয়াজের আড়ালে

বললে মৃদুস্বরে,

”কিছু মনে কোরো না,

সময় কোথা সময় নষ্ট করবার !

আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই ;

দূরে যাবে তুমি,

দেখা হবে না আর কোনোদিনই ।

তাই,যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে,

শুনব তোমার মুখে ।

সত্য করে বলবে তো ?”

আমি বললেম ,’বলব ।’

বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়েই শুধোল,

”আমাদের গেছে যে দিন

একেবারেই কি গেছে —

কিছুই কি নেই বাকি ?”

একটুুকু রইলেম চুপ করে ;

তারপর বললেম,

”রাতের সব তারাই আছে

দিনের আলোর গভীরে ।”

খটকা লাগল , কী জানি বানিয়ে বললেম নাকি ।

ও বললে, ‘থাক্, এখন যাও ও দিকে ।’

সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে ।

আমি চললেম একা ।।

[শান্তিনিকেতন/ ১০ আষাঢ় ১৩৪৩ ]

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *