রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা,
ভাবি নি সম্ভব হবে কোনোদিন ।।
আগে ওকে বারবার দেখেছি
লাল রঙের শাড়িতে—-
দালিম-ফুলের মতো রাঙা ;
আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়,
আঁচল তুলেছে মাথায়
দোলন-চাঁপার মতো চিকন-গৌর মুখখানি ঘিরে ।
মনে হল , কালো রঙে একটা গভীর দূরত্ব
ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চারদিকে,
যে দূরত্ব সর্ষেক্ষেতের শেষ সীমানায়
শালবনের নীলাঞ্জনে ।
থমকে গেল আমার মনটা
চেনা লোককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে ।।
হঠাৎ খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে
আমাকে করলে নমস্কার ।
সমাজবিধির পথ গেল খুলে ;
আলাপ করলেম শুরু—
” কেমন আছ ,’ কেমন চলছে সংসার’ ইত্যাদি ।
সে রইল জানলার বাইরের দিকে চেয়ে
যেন কাছের-দিনের-ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে ।
দিলে অত্যন্ত ছোটো দুটো-একটা জবাব,
কোনোটা বা দিলেই না
বুঝিয়ে দিলে হাতের অস্থিরতায়—
কেন এ-সব কথা,
এর চেয়ে অনেক ভালো চুপ ক’রে থাকা ।।
আমি ছিলেম অন্য বেঞ্চিতে ওর সাথিদের সঙ্গে ।
এক সময়ে আঙুল নেড়ে জানালে কাছে আসতে ।
মনে হল কম সাহস নয়—
বসলুম ওর এক-বেঞ্চিতে ।
গাড়ির আওয়াজের আড়ালে
বললে মৃদুস্বরে,
”কিছু মনে কোরো না,
সময় কোথা সময় নষ্ট করবার !
আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই ;
দূরে যাবে তুমি,
দেখা হবে না আর কোনোদিনই ।
তাই,যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে,
শুনব তোমার মুখে ।
সত্য করে বলবে তো ?”
আমি বললেম ,’বলব ।’
বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়েই শুধোল,
”আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেই কি গেছে —
কিছুই কি নেই বাকি ?”
একটুুকু রইলেম চুপ করে ;
তারপর বললেম,
”রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে ।”
খটকা লাগল , কী জানি বানিয়ে বললেম নাকি ।
ও বললে, ‘থাক্, এখন যাও ও দিকে ।’
সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে ।
আমি চললেম একা ।।
[শান্তিনিকেতন/ ১০ আষাঢ় ১৩৪৩ ]